নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
মিহির কান্তি মজুমদার। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনুসারী। সাবেক সচিব ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বরগুনা সদর আসন থেকে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক এই আমলা। নৌকার মনোনয়নপত্রও তুলেছিলেন। তবে টিকিট পাননি। কর্মজীবনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার নাম মিহির কান্তি মজুমদার। চাকরি জীবনে তিনি যে প্রতিষ্ঠানে গেছেন সেই প্রতিষ্ঠানকেই ডুবিয়েছেন। লোপাট করে পথে বসিয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার বানিয়ে নামে-বেনামে বিপুল অর্থ তছরুপ করে বিপুল বিত্তের মালিক বনে গেছেন মিহির কান্তি। শুধু নিজে নয়, ধনী বানিয়েছেন স্ত্রী- সন্তান, ভাইবোনদেরও। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মিহির এখন টাকার বালিশে ঘুমান। কীভাবে তার এই উত্থান? কোন উপায়ে শতকোটি টাকার মালিক হলেন মিহির। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত মিহির তালতলী উপজেলায় এক আতঙ্কের নাম। নিজের পদ ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে আয়ের টাকায় গড়েছেন বাংলো বাড়ি, একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট, মাছের ঘের, গরুর খামার, কুমিরের খামার, একরের পর একর জমি, হাউজিং কোম্পানি আরও কতো কি। শুধু বাংলাদেশে নয়, অঢেল সম্পদ কিনেছেন ভারতেও। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে মিহির কান্তির সম্পদ বেড়েছে স্রোতের বেগে। সরকারি চাকরি শেষে অবসরে গিয়েও তেলেসমাতি দেখিয়েছেন সাবেক এই সচিব। অল্প সময়ে তিনি একাধিক এনজিও’র শীর্ষ পদ দখল করে আলোচনায় আসেন। এনজিওতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে কৌশলে শতকোটি টাকা সরিয়ে নেন। নামে-বেনামে অপ্রয়োজনীয় নানা কাগুজে প্রকল্প সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এনজিওগুলোকে পথে বসিয়েছেন। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ‘প্রোব বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ভারতে শতকোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে মিহির কান্তি মজুমদারের বিরুদ্ধে। তবে কোনো কিছুই পাত্তা দেননি মিহির। পাত্তা দেননি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদনকেও। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরেও মিহিরের প্রভাবের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে উদ্দীপন নামের একটি এনজিও। ওই এনজিও থেকে বেআইনিভাবে নামসর্বস্ব প্রকল্প নিয়ে ৭ বছরে প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এনজিও কর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়ে পুরো এনজিওটি দখলের পাঁয়তারা করছে মিহির কান্তি। এমন বেশ কয়েকটি মামলার কাগজ মানবজমিনের হাতে এসেছে। গত কয়েকদিনে এনজিও অফিস ও মিহির কান্তির নামে-বেনামে গড়া প্রকল্পে সরজমিন ঘুরে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিহির কান্তি মজুমদার তার ছোট ভাই পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদারের ক্ষমতা ব্যবহার করে বরগুনার তালতলী উপজেলায় সাড়ে ৯ একর জমি দখলে নিয়ে মাছের ঘের করেছেন। এ ছাড়া ওই এলাকায় তাদের আরও প্রায় ২৯ একর জমি রয়েছে। ২০২৩ সালে এক বিধবা নারীর ২ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে সেখানে ড. এমকে মজুমদার নামে স্কুল নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া প্রোব বাংলাদেশ নামে একটি মেডিকেয়ার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয় দাশ নামের একজন ভারতীয় নাগরিককে ব্যবহার করে মিহির কান্তি ভারতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কমিশনের বিনিময়ে পল্লী সঞ্চয়ের ১৭০০ কোটি টাকা মেঘনা ও রূপালী ব্যাংকে জমা রেখে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা সুবিধা নিয়েছেন মিহির কান্তি।
যেভাবে বিঘা বিঘা জমি দখল করেন মিহির: বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নের বড় নিশানবাড়িয়া মৌজার এসএ ৬২, ৭২ ও ৪০৩ দাগে ৯ একর ২০ শতাংশ জমি দখলে নেন সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার, তার স্ত্রী ড. গীতা রানী ও তার ভাই বনজ কুমার মজুমদার। ওই জমির প্রকৃত মালিক মোস্তফা কামাল। তিনি বিএনপিপন্থি হওয়ায় নানা চেষ্টার পরেও জমি উদ্ধার করতে পারেননি। জমি দখলের সময় বাধা দিলে স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী সোহেল, জুয়েল, সজীব, ফারুক খান, মাসুমের নেতৃত্বে মোস্তফার ওপর হামলা করে তার হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়। এ ছাড়াও সচিব মিহির কান্তি মজুমদার, স্ত্রী গীতা রানী, ভাই বনজ কুমার ক্ষমতার অপব্যবহার করে একই এলাকার ফুল মিয়া ও ফরিদা বেগমের ৩ একর জমি দখল করে সেই জমিতে ড. এমকে মজুমদার নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রী ডা. গীতা রানী নামে নিশানবাড়িয়া মৌজায় বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ নং খতিয়ানে ৫.৩২ একর, ৭২ নং খতিয়ানে ৫.২৭ একর, ৬২ নং খতিয়ানে ২.৪৭ একর, ১৯৯ নং খতিয়ানে ২.১৩ একর, ২১৪ নং খতিয়ানে ১.২৭ একর, ৩০৬ নং খতিয়ানে ২.২০ একর। মোট ১৮.৬৬ একর জমি রয়েছে মিহির কান্তি ও তার স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া বনজ কুমার ও তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৭২ নং খতিয়ানে ৩.২৭ একর, ৬২ নং খতিয়ানে ২.২০ একর, ১৯৯ নং খতিয়ানে .৮৪ একর, ৩০৬ নং খতিয়ানে ১.৪৮ একর। মোট জমি রয়েছে ৭,৭৯ একর। একই মৌজায় মিহির কান্তির পার্টনার হিসেবে জমি দখলে রয়েছেন টিপু সুলতান ও নওশের ইসলাম নামের দুই ব্যক্তি। তাদের মধ্যে টিপু সুলতানের জমি ১৪.৬৭ একর। আর নওশেরুল ইসলামের জমি ৮.৫৫ একর। এসব জমির মধ্যে ১০ একর জায়গা জুড়ে মিহির কান্তির বিশাল মাছের ঘের রয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর কাপাসিয়া এলাকায় বনের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে মিহির কান্তি মজুমদারের বিরুদ্ধে।
ঢাকায় যত ফ্ল্যাট, প্লট: ঢাকা শহরের শান্তিনগর, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, সেগুনবাগিচা, ধানমণ্ডি, গুলশানে মিহির কান্তি ও তার স্ত্রী গীতা রানী মজুমদারের নামে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। এরমধ্যে শান্তিনগর ডিবিএল রোল কটেজে দু’টি ফ্ল্যাট রয়েছে মিহির কান্তির। ফ্ল্যাট নং ৩-এ এবং ১-৭। মোহাম্মদপুরের আদাবরে একটি বাড়ি রয়েছে। একই এলাকার খিলজী রোডে ২২০০ স্কোয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে স্ত্রী গীতা রানীর নামে। মোহাম্মদপুর জাপান গার্ডেন সিটির বিল্ডিং নম্বর-২ তে মিহির কান্তির আরও একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বছিলায় দু’টি ৫ কাঠার প্লট রয়েছে বলেও জানা গেছে। এ ছাড়া পিরোজপুরের চালিতাখালিতে ২০ বিঘা জমিতে মিহির একটি বাংলো বাড়ি করেছেন। বাড়িটি উদ্দীপনের মৎস্য প্রজেক্টের পাশেই। বরগুনা উপজেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় মিহির কান্তির দু’টি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। পৈতৃক নিবাস পিরোজপুরে হলেও মিহির কান্তি বরগুনার তালতলী উপজেলাকে গ্রামের বাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানেই তিনি বসবাস করেন। ওই আসন থেকেই তিনি নৌকার টিকিট চেয়েছিলেন।
কটি এনজিও থেকে ২৩০ কোটি টাকা সরান মিহির: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে উদ্দীপন নামের একটি এনজিওতে যোগদানের পর থেকেই এনজিওটির কার্যপ্রণালী ও মাইক্রোক্রেডিট অথরিটির অনুমতির বাইরে গিয়ে নামে-বেনামে শত শত প্রকল্প হাতে নেন মিহির কান্তি মজুমদার। উদ্দেশ্য ছিল কৌশলে টাকা সরিয়ে নেয়া। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন এনজিওটির সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ হোসেন তালুকদার। মিহির কান্তির অনিয়মে এনজিওর কর্মকর্তারা বাধা দিলে কয়েক জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অল্প দিনেই নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে মিহির কান্তি মজুমদারের বিরুদ্ধে। নামসর্বস্ব প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্দীপন এনার্জি (ইউইএল) ও উদ্দীপন রিনিউয়াল এনার্জি (ইউআরইএল), সোলার ইরিগেশন, রংপুর গোল্ড ব্রিকস ইটভাটা ক্রয়, ভাকুর্তা-১ ও ২ প্রকল্প, যশোর নার্সারি, ভালুকায় রেপটাইলস কুমিরের খামার ক্রয়, চালিতাখালী কৃষি প্রকল্প, এ অ্যান্ড পি ব্যাটারি কোম্পানি, সীডস বল প্রজেক্ট, সিমুলেশন টেক ল্যাব, ভাকুর্তা মিল্ক প্রসেসিং, উদ্দীপন এগ্রো লিমিটেড, উদ্দীপন টিভি, উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ, কৃষি পাঠশালা, প্রাণিসম্পদ ব্যাংক, পাখি পল্লী সৃজন, কল সেন্টার, নারী ফার্মেসি, ভাসমান কৃষি, আমাদের গ্রাম ক্যান্সার হাসপাতাল, পল্লী এম্বুলেন্স, কচুরিপানা প্রজেক্ট, মেঘনা ব্যাংকে ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ, রূপগঞ্জ প্রজেক্ট, বিউটি পার্লার, কল সেন্টার, ক্রিম অ্যান্ড ক্রিস্ট সুইটস, নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইউআরইল প্রজেক্ট হাসপাতাল, হিসাব অ্যাপ, গ্রাম বাংলা সিস্টেম, স্বাস্থ্য আপা, হেলথ বক্স, স্বাস্থ্য কার্ড, প্রোব বাংলাদেশ, যানবাহন ও ক্লাউড ডাটাবেজ। এসব প্রকল্পের আড়ালে মিহির কান্তি মজুমদার প্রায় ৪০৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। যার মধ্যে ২৩০ কোটি টাকাই বিভিন্ন অনিয়ম করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এমনকি মাইক্রোক্রেডিট অথরিটিও তাদের অনুসন্ধানে এসব অনিয়মের তথ্য সংবলিত প্রতিবেদন দিয়েছে। এ ছাড়া পিকেএসএফ ও মাইক্রোক্রেডিট অথরিটির অডিট রিপোর্ট ও অর্থ আত্মসাতের সমস্ত দলিলাদি মানবজমিনের হাতে সংরক্ষিত আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উদ্দীপনের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান মিহির কান্তি এমন কিছু প্রকল্প নিয়েছেন যা উদ্দীপনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এম আর এ বারবার সতর্ক করার পরেও তিনি কিছু বেআইনি প্রকল্প নিয়েছেন। তিনি কারও কথা শোনেননি। তিনি প্রতিটি প্রকল্পে ৫ টাকা খরচ হলে ১০ টাকা তুলে নিয়েছেন। যার কোনো হিসাব উদ্দীপনকে আজও দেননি। যেমন ভাকুর্তা-১ ও ভাকুর্তা-২, রূপগঞ্জ প্রকল্পে জমি ক্রয়ে সর্বোচ্চ ৪ কোটি টাকা লাগার কথা। কিন্তু তিনি ৯ কোটি টাকা দেখিয়েছেন। ভাকুর্তায় জমি ক্রয় ও মিল্ক প্রসেসিং এবং গেস্ট হাউস নির্মাণে ৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়। রূপগঞ্জ প্রকল্পে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি বিল্ডিং ডেকোরেশন করা হয়। কচুরিপানা কাটার জন্য অতিরিক্ত দামে মেশিন ক্রয় করা হয়। ৯ কোটি টাকা খরচ করে রংপুরের মিঠাপুকুরে গোল্ড ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা ক্রয় করা হয়। এই ইটভাটা ২ কোটির বেশি হবে না। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রতিবেদনও দিয়েছে। এ ছাড়া ভালুকায় কুমিরের খামারের নিলাম মূল্য উঠেছিল ২৩ কোটি তিনি ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। কারণ মিহির কান্তির সঙ্গে পিকে হালদারের বন্ধুত্ব ছিল। তার মাধ্যমে আঁতাত করেই চড়া দামে এই খামার কেনা হয়েছে। চালিতাখালী কৃষি প্রকল্পে স্থানীয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে ৩ কোটি ৫ লাখ টাকায় জমি কেনা হয়। ওই জমির দাম ১ কোটি টাকাও হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উদ্দীপনের একজন জোনাল ম্যানেজার মানবজমিনকে বলেন, হেলথ বক্স, স্বাস্থ্য কার্ড, প্রোব বাংলাদেশ, জোন পর্যায়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে প্রায় ২৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া এনজিওর জন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে হিসাব নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে ১৮ মাসে ১৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়। অথচ এই অ্যাপ উদ্দীপনের এক পয়সারও কাজে আসেনি। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। এই অনিয়ম নিয়ে এমআরএ তদন্ত করে মিহির কান্তির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে। সে এর কোনো সঠিক জবাব দিতে পারেনি। চেয়ারম্যানের পদ গেলেও তিনি আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। ফিরে আসলে আর উদ্দীপন থাকবে না। ২০১৭ সাল থেকে ’২৩ সাল পর্যন্ত তিনি শত শত কোটি টাকা সরিয়েছেন। উদ্দীপনের কেউ কিছু বলার সাহস পাননি।
প্রোব বাংলাদেশের মাধ্যমে টাকা পাচার: মিহির কান্তি মজুমদার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হেলথ কমসূচি পার্টনার ভারতীয় কোম্পানি প্রোবের সঙ্গে একটি অসম চুক্তি করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিক বিজয় দাসের মাধ্যমে ভারতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। প্রোবের হেলথ প্যাকেজে উদ্দীপনের পুরো টাকায় লস হয়েছে বলে জানিয়েছেন বোর্ড সদস্যরা। এ ছাড়া এই বিজয় কুমারকে উদ্দীপনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেড় বছর ধরে বিনা ভাড়ায় বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে মিহির কান্তি ও প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক বিদ্যুৎ কুমার বসু। তবে উদ্দীপনের পক্ষ থেকে একাধিকবার নোটিশ দিয়েও বিজয় কুমারকে কার্যালয় থেকে সরানো যায়নি।
এমআরএ তদন্তে যা বেরিয়ে আসে: এদিকে মিহির কান্তি মজুমদারের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ তছরুপের কারণে ডুবতে বসা উদ্দীপনকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি। তাদের প্রাথমিক তদন্তেও বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের তথ্য উঠে আসে। পরে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণসহ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ও পরিচালনা পর্ষদের সভায় অথরিটির পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানকে ১ বছরের জন্য পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
যেভাবে ব্যাংক থেকে টাকা হাতিয়ে নেন: ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে প্রায় ১৪৯ জনকে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি তারা তড়িঘড়ি করে তাদেরকে বিভিন্ন উপজেলায় পদায়ন দেয়া হয়। এ ছাড়া পুরনো কর্মীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাংকটিতে ৪৮৫ জন ক্যাশ সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগে প্রক্রিয়ার ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান উদ্দীপনের দেয়া তথ্য বলছে, উদ্দীপনের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১১৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৩৭ কোটি, জুন ২০২৩ বছরে ১০৪ কোটি টাকা। এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২৩ কোটি টাকাসহ মোট ৩৭৮ কোটি টাকা রিশিডিউল করা হয়। এদিকে রিশিডিউল করে সংস্থায় ভুয়া লাভ দেখানোয় এনজিওটির মারাত্মক অর্থ ঝুঁকি ও সংকটে পড়ে। উদ্দীপনের দেয়া তথ্য বলছে, এনজিওটির নিয়োগ প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করেছেন মিহির কান্তি মজুমদার। নিজের পছন্দমতো কর্মী নিয়োগ ও পরিচিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেনননি এমন অভিযোগও রয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্দীপন ব্যাপক আর্থিক সংকটে ভুগছেস্বাস্থ্য কার্ড মিহিরের টাকা লোপাটের ট্রাম্পকার্ড: ২০২০ সালে বড় অশুভ পরিকল্পনা করেন মিহির কান্তি। ঋণ বিতরণের সময় উদ্দীপনের সারা দেশের লক্ষাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে স্বাস্থ্যকার্ড বাবদ ১ হাজার ২০০ টাকা কেটে নেয়া হয়। এমআরটির নিয়মের বাইরে গিয়ে জোরপূর্বক এই প্রকল্প চালু করেন মিহির কান্তি। পরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ বছরে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা আদায় করে কৌশলে তা সরিয়ে নেয়া হয়।
যা বলছেন মিহির কান্তি মজুমদার: অভিযোগের বিষয়ে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এমআরএ কি প্রতিবেদন দিয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি ব্যক্তিগভাবে কোনো প্রকল্প নেইনি। প্রতিটি প্রকল্প বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে নেয়া হয়েছে। বোর্ড মিটিংয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা গৃহীত হয়েছে। আমার একার সিদ্ধান্তে কোনো প্রকল্প নেয়ার সুযোগ নেই। আর আমি এনজিও’র কেউ না। পরিচালনা বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমি শুধুমাত্র তাতে স্বাক্ষর করেছি। এখানে অর্থ লোপাটের মতো কিছু ঘটেনি। উদ্দীপনের প্রকল্প এখনো দৃশ্যমান রয়েছে। তাদের সম্পদ তাদেরই রয়ে গেছে। আমি তাদের কোনো সম্পদ সরিয়ে নেইনি। এটা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যত অভিযোগ এসেছে সব মিথ্যা।